আর্কাইভ  সোমবার ● ২৫ আগস্ট ২০২৫ ● ১০ ভাদ্র ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২৫ আগস্ট ২০২৫
একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে বলল বাংলাদেশ

একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে বলল বাংলাদেশ

জয়ের জটিল সমীকরণ

জয়ের জটিল সমীকরণ

হাসিনার মামলায় ১৬ চানখাঁরপুল মামলায় ৮ জনের সাক্ষ্য শেষ

জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ
সীমাহীন বর্বরতা
হাসিনার মামলায় ১৬ চানখাঁরপুল মামলায় ৮ জনের সাক্ষ্য শেষ

ছুটিতে পাঠানো সেই ১২ বিচারপতি কোথায়?

ছুটিতে পাঠানো সেই ১২ বিচারপতি কোথায়?

মে দিবস প্রসঙ্গ: আমাদের দেশের শ্রমিকরা  এখন আর আধপেটা থাকে না

সোমবার, ১ মে ২০২৩, দুপুর ১১:৫৩

Advertisement Advertisement

 নজরুল মৃধা
মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় নির্যাতিত শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কথা। বুর্জুয়া শ্রেণীর যাতাকলে পিষ্ট হয়ে শ্রমিকরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল ১৮৮৬ সালে পহেলা মে। মে দিবস এলে শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে মাঠে নামে। আমাদের দেশেও এর ব্যত্যয় ঘটে না। শ্রমিকদের আন্দোলনের এই দিনে আমাদের দেশের শ্রমিকদের অতিত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশে একটা সময় ছিল শ্রমিক মানে আধপেটা খাওয়া মানুষ। সারাদিন কাজ করে এক বেলা খাবার আরেক বেলা উপাস কিংবা অর্ধ উপাস থাকা।  গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা-কাচ্চা। বাপের যে পেশা বড় হয়ে বাবার পেশা শ্রমিক হতে হবে এটাই ছিল এক ধরনের নিয়ম। কিন্তু শ্রমিকদের এখন আগের অবস্থা নেই। অবস্থা পাল্টেছে। এখন একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের চেয়ে শ্রমিক শ্রেণিরা বেশ ভালো আছে। করোনা মহামারি, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতি কিছুটা হোচট খেলেও এদেশের শ্রমিক শ্রেণিরা এখন পর্যন্ত ভাল আছেন বলা যেতে পারে। 

একটি নিম্নবিত্ত পরিবার যেমন ছোটখাট দোকানদার, ছোটখাট চাকরিজীবীদের আয় যেখানে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। সেখানে একজন শ্রমজীবী মানুষ দিনে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত প্রতিদিন আয় করছে। বর্তমানে ধান কাটার মৌসুম চলছে। ধান কাটার শ্রমিক পাওয়াই দুস্কর হয়ে পড়েছে। এজন শ্রমিককে দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে।  শ্রমিক সংকট ও শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার দলের নেতাকর্মীরা কৃষকের জমির ধান কেটে দিচ্ছেন। এধরনে খবর প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় আসছে। তবে সব শ্রেণির শ্রমিক যে উচ্চ মূল্য পাচ্ছেন এটা যেমন ঠিক না তেমনি সব শ্রমিকই যে খারাপ অবস্থায় আছে এটা বলা যাবে না। 

বাংলাদেশের শ্রমিকরা পোষাক শিল্পে বড় একটা স্থান দখল করে রেখেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুয়ায়ি ২৫ থেকে ৩০ লাখের মত হবে পোষাক শ্রমিক। এর অধিকাংশই নারী শ্রমিক।  প্রথম দিকে এদের অবস্থা নাজুক থাকলেও এখন এরা বেশ ভাল আছে বলা চলে। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বলা চলে পোষাক শিল্পের শ্রমিকরা মোটামুটি সন্তোষ্ট। পরিবহণ শ্রমিকদের কথা বলতে গেলে বলা যায় তারাও খুব ভালো আছেন। গত ১০/১২ বছর থেকে পরিবহণ জগতের একাধিক নেতা সরকারের অংশ হওয়ায় এই সেক্টরে বড় ধরনের কোন অসন্তোষ দেখা যায়নি। আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হলেও তাদের দীর্ঘ দিনের দাবি নিয়োগ পত্র পাওয়ার বিষয়টি এখনো রয়ে গেছে উপেক্ষিত। 

পোষাক শিল্প,পরিবহন ছাড়াও অন্যান্য খাতে যারা শ্রম বিক্রি করছে তারাও ভালো আছেন। একজন রাজমিস্ত্রী,রং মিস্ত্রী. অথবা দিন হাজিরার মজুর দিনে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭’শ টাকা আয় করছেন। আগে আশ্বিন- কার্তিক মাসে কাজ না থাকার কারণে শ্রমজীবী মানুষদের মাঝে হাহাকার দেখা দিত। তারা এক বেলা খেত। আরেক বেলা অনাহারে থাকতো। এখন সেই অবস্থা নেই। বলা চলে বছরের বারো মাসই কাজ করছেন। কাজের অভাবে কাউকে এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। দুই  থেকে তিনদশক আগেও আমরা লক্ষ্য করেছি শ্রমিকের সন্তান বড় হয়ে পরবর্তিতে শ্রমিকের কাজ করছে। বর্তমানে এই অবস্থাটাও পাল্টেছে। অনেক শ্রমিকের সন্তানই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি ভাল চাকরি করছেন। চাকরি করে তারা তাদের বাবা মাকে শ্রমিকের পেশা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আগে আমরা আরেকটি জিনিষ লক্ষ্য করেছি। তা হল শ্রমিক শ্রেণির মানুষের অধিক সন্তান গ্রহণ করা। তাদের চিন্তাভাবনা ছিল ছেলে বড় হয়ে বাবার কাজে সহযোগিতা করবে। এধরণের নানান অজ্ঞতায় শ্রমিক বাবারা ঘনঘন সন্তান নিতেন বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে। এ অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। অধিকাংশ শ্রমিকই  এখন একটি কিংবা দুটি সন্তানের অধিক গ্রহণ করছেন না। শ্রমিক শ্রেণির আয় ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বড় ভূমিকা কথা বলতে গেলে বেশ কিছু প্রসঙ্গ এসে যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি,রেমিটেন্স বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি , মালিক- শ্রমিকের সহবস্থান ইত্যাদি। 

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮১৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে গড়ে ২ লাখ ৪০ হাজারের বেশি টাকা আয় করেন। দেশের মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয় বের করা হয়। বাংলাদেশে রেমিটেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিমাসে শত শত কোটি টাকা রেমিটেন্স আসছে। এর ফলে উপকৃত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণি থেকে আরাম্ভ করে সর্বশ্রেণির মানুষ। গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে কর্মক্ষমতাও কিছুটা বেড়েছে। নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের শ্রমিকরা আর আগের অবস্থানে নেই। তবে যতই ভাল থাকুক না কেন শ্রমিক শ্রেণির কিছু যৌক্তিক দাবি এখনো রয়ে গেছে উপেক্ষিত। 

তার আগে মে দিবস প্রসঙ্গে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ গুলি চালালে নিহত হয় কয়েকজন। আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেককেই বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। সে দিনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সাড়া বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারীভাবে ৮ ঘন্টা কর্ম দিবস। ৮ ঘন্টার বেশি কেউ পরিশ্রম করলে তাকে অতিরিক্ত সময়ের জন্য পারিশ্রমিক দিতে হবে। তাই সাড়া বিশ্বে পালিত হয় পহেলা মে’ মহান মে দিবস’।

একদশক আগে আমাদের দেশে শ্রমিকদের অধিকার আদায় এর নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছিল। সকল শ্রমিক সংগঠনগুলো একটি দলমত নির্বিশেষে একটি ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল। বহুধা বিভক্ত মতবিরোধের মধ্যেও এক প্লাটফর্মে আসার কথা শোনা গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রায় সবকটি ট্রেড ইউনিয়ন এক সংগে সংযুক্ত হবে এবং নতুন একটি সংগঠন হবে। এর কোন রাজনৈতিক পরিচয় থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে সে প্রচেষ্টাকে বিফল বলা চলে। শ্রমিক স্বার্থে সকল শ্রমিক সংগঠনগুলো এক হয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে চামচাগিরি করা। ক্ষমতাসীন ও বিরোধি দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাতে এক শ্রেণীর শ্রমিক নেতারা যেমন আত্মতৃপ্তি পায় তেমনি নিজেদের আখের গোছাতে একেক জন সিদ্ধহস্ত। এখানে গিয়েই দেশের সাধারণ শ্রমিক, মহিলা শ্রমিক ও শিশু শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়ন বাধা গ্রস্ত হচ্ছে।

শিশু শ্রম প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলা চলে বাংলাদেশে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি সনদ ঘোষণা করেছে। মোট ১২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম উক্ত সনদে স্বাক্ষর করেন। ১৮ বছরের নিচে কাজ করা নিষিদ্ধ। এ নিষেধাজ্ঞা কাগজে কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ ও করুণ। এদেশে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাস, ট্রাক, টেম্পু, রিক্সা, কলকারখানা ও ক্ষেত খামারে শিশুদের অমানবিকভাবে খাটানো হচ্ছে। দারিদ্র্যতার কারণে তারা শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে সরকার শিশু শ্রম বন্ধে একটি টার্গেট নিয়েছে। আশা করি সরকারের টার্গেট পুরুন হলে এক সময় এদেশে শিশু শ্রম থাকবে না। 
এ দেশে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যাও নগন্য নয়। নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ করছে। এদেশে গার্মেন্টস গুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ মহিলা শ্রমিক। রানাপ্লাজা’র মত ভবন ধস কিংবা তাজরিনে অগ্নিকান্ডে শত শত শ্রমিক প্রাণ হারালেও বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। এর মূল কারণ তাদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব। তবে এখন অনেক কারখানাই  ভাল হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে স্বীকৃতি পয়েছে। এদেশের মহিলা শ্রমিকেরা  এক সময় নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে কাজ করেছে। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে স্বাস্থ্যহীনতা সহ নানা মুখি সমস্যায় ভুগছিল।  তবে ওই অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলা চলে। তবে সর্বক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে না পারলে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবই বেশি। শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী আদায় এর ক্ষেত্রে শ্রমিক নেতাদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়া উচিত। ভেদাভেদের কারণে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় যে শ্রমিক নেতারা শ্রমিক স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থটিকে বড় চোখে দেখেন। রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর শ্রমিক সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এ কারণে অনেক সময় শ্রমিক নেতারা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিক স্বার্থে কাজ করতে যেয়ে রাজনৈতিক মতভেদের কারণে নিজেদের মধ্যে হানাহানি রক্তক্ষয়ে জড়িয়ে পড়েন। ক্ষেত্র বিশেষে সংগঠনের নেতারা রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখতে সচেষ্ট হলেও ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে সচেতন এবং এদেরকে মাঠে ময়দানে রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক বৃত্তের বলয় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশের শ্রমিকরা আরো অনেক অনেক ভালো থাকতে পারবে বলে মনি করি।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন


Link copied